বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ দিতে গেলে যা যা মনে রাখতেই হবে

মাসুমা চৌধুরী

বন্যায় যারা পানিবন্দি হয়ে আছে, তাদের কাছে নেই কোনো খাবার কিংবা জরুরি কোনো ত্রাণ সামগ্রী। ফাইল ছবি

দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যাকবলিত এলাকার পানিবন্দি মানুষেরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে বাড়িঘর, রাস্তা, মাঠ-ঘাট আর ফসলের জমি। লাখ লাখ শিশু ও তাদের পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে, তাদের কাছে নেই কোনো খাবার কিংবা জরুরি কোনো ত্রাণ সামগ্রী। বন্যায় দেশের পূর্বাঞ্চলের ২০ লাখেরও বেশি শিশু এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ।

বন্যার্তদের সাহায্যার্থে বিপুল সংখ্যায় মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন। রোদ–বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তারা ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে এমন খাবার দেওয়া প্রয়োজন, যেসব খাবার বন্যাকবলিত এলাকাল মানুষদের উপকারে আসে এবং তারা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে না পড়েন।

এ ক্ষেত্রে বলতে হয়, অনেকেই হয়ত জানেন না, ত্রাণসামগ্রী হিসেবে গুঁড়ো দুধ দেওয়ার ক্ষেত্রে এমন কিছু আইনি বিধিনিষেধ আছে, যা বাংলাদেশসহ অনেক দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বন্যার সময় দেখা যায়, নিরাপদ পানির অভাবে লোকজন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দূষিত পানি দিয়ে দুধ গুলিয়েই শিশুকে খাইয়ে দেন। এতে বন্যায় আক্রান্ত এলাকায় শিশুর ডায়রিয়ায়সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২-এর দ্বিতীয় ধারার ১১ অনুচ্ছেদে দুর্যোগে বিপর্যস্ত নানা রকমের ব্যক্তির সঙ্গে পাঁচ বছরের নিচে যেকোনো শিশুর জন্য মায়ের দুধের বিকল্প, বাণিজ্যিকভাবে তৈরি শিশুর বাড়তি খাবার ইত্যাদি বিতরণকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এসব আইন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মাঠকর্মীদের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ও জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে ২০২০ সালে একটি নির্দেশিকা তৈরি করে। এর ভিত্তিতে বলতে হয়, গুঁড়ো দুধ মায়ের দুধের বিকল্প ছাড়া আর কিছু নয়। জুস, দোকান থেকে কেনা দুধের বোতল, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত করা শিশুখাদ্য শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

তবে ওপরে উল্লিখিত নিষেধাজ্ঞাটি নিছক আইনি নয়, এর একটি বৈজ্ঞানিক ও নৈতিক ভিত্তি রয়েছে। শিশুদের ক্ষেত্রে এসবের স্বাস্থ্যঝুঁকি মাত্রাতিরিক্ত। পুষ্টিবিদেরা তাই শিশুখাদ্যের ব্যাপারে অনেক বেশি সাবধান হতে বলেন।

দুর্যোগকালীন খাদ্য সরবরাহ থেকে প্রতিদিন একজন ব্যক্তির ২১০০ ক্যালরি শক্তি চাহিদা পূরণ করা বাঞ্ছনীয় (আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুযায়ী)। দুর্যোগকালীন সময়ে বিভিন্ন ফরটিফাইড খাদ্য যেমন চাল, তেল, বিস্কুট ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।

দুর্যোগকালীন সময়ে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়া ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে তাৎক্ষণিক পুষ্টি পূরণে চাল ডাল, সবজি, ডিম সহযোগে খিচুড়ি অথবা ন্যূনতম ২ থেকে ৩ দিনের শুকনো খাবার দেওয়া যেতে পারে। যে সকল পরিবারে ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী শিশু বিদ্যমান তাদেরও প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণে বাড়তি খাদ্য প্যাকেজ দেওয়া জরুরি।

এছাড়া নবজাতক শিশু থেকে ৫ (পাঁচ) বছর বয়সের শিশুর খাদ্য নির্বাচনে মাতৃদুগ্ধের বিকল্প শিশু খাদ্য পরিবারের জন্য নির্ধারিত খাদ্য প্যাকেজের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এর সঙ্গে একটি বা দুটি অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার রাখা যেতে পারে।

নিম্নে বিভিন্ন অবস্থায় প্রযোজ্য সুপারিশকৃত খাদ্যতালিকার দেওয়া হলে। যেমন:

১. দুর্যোগ পরবর্তী আশ্রয় কেন্দ্রে তাৎক্ষণিক খাদ্য সরবরাহের সুপারিশকৃত খাদ্যতালিকা (৫ সদস্যের পরিবারের তিন দিনের জন্য): চিড়া ৪.৫ কেজি, চিনি/ গুঁড় ৫০০ গ্রাম, পুষ্টি সমৃদ্ধ ফরটিফাইড বিস্কুট ১৫ প্যাকেট (৭৫ গ্রাম প্যাকেট), চিনির পরিবর্তে লাল চিনি অথবা গুঁড় অধিক পুষ্টি সম্পন্ন। চিড়া ও চিনি ক্রয় করা সম্ভব না হলে ফরটিফাইড বিস্কুট দিয়ে চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে। খাদ্য প্যাকেজের সঙ্গে পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে।

২. শুকনো খাবারের পরিমাণসহ খাদ্যতালিকা (৫ সদস্যের পরিবারের ৭ দিনের খাবার): পুষ্টি চাল (ফরটিফাইড), ফরটিফাইড তেল ১৩ কেজি, ডাল ১.৫ কেজি, চিড়া ২ কেজি, আয়োডিন যুক্ত লবণ ১ কেজি, চিনি/গুঁড় ৫০০ গ্রাম, মটর বা মুগ ডাল ২ কেজি।

৩. শিশু খাদ্যের পরিমাণসহ খাদ্যতালিকা (পরিবারে ৬-৭ বছর বয়সী ৫৯ মাস বয়সী শিশুর সংখ্যা ২ জন ধরে ৭ দিনের খাবার): পুষ্টি চাল (ফরটিফাইড) ১ কেজি, ফরটিফাইড তেল ৫০০ মিলিগ্রাম, ডাল ৫০০ গ্রাম, সুজি ৫০০ গ্রাম, ফরটিফাইড বিস্কুট ১ কেজি (১৫ প্যাকেট), চিনি/গুঁড় ১০০ গ্রাম, বাদাম ভাজা ৫০০ গ্রাম, খেজুর ৫০০ গ্রাম। (ফরটিফাইড চালের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। তবে ফরটিফাইড চাল না পেলে সাধারণ চাল দেওয়া যেতে পারে।

৪. দুর্যোগকালীন খাদ্যের পরিমাণসহ খাদ্যতালিকা (৫ সদস্যের পরিবারের ৭ দিনের খাবার): চাল ১০ কেজি, ফরটিফাইড তেল ১ লিটার, ডাল ১ কেজি, পেঁয়াজ ১ কেজি, আয়োডিন যুক্ত লবণ ১ কেজি, আলু ৫ কেজি।

লেখক: পুষ্টিবিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *